bannerbanner
সময়ের অন্তর
সময়ের অন্তর

Полная версия

সময়ের অন্তর

Настройки чтения
Размер шрифта
Высота строк
Поля
На страницу:
4 из 5

কিওকো তাৎক্ষণিকভাবে তার চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। এ কী হল তার? ও তো এখানে প্রশ্ন করতে এসেছিল, রূপের বশে বশীভূত হতে নয়। কিওকো যখন তার চোখ খুলল, পুরুষটি তখন তার অনেক কাছে চলে এসেছিল। সে সঙ্গে-সঙ্গে সেই রাজকীয় ও উদ্ধত চেহারা-ছবি থেকে এক কদম পিছনে চলে গেল এবং পিঠে দরজার স্পর্শ পেল... যা তাকে আটকে রাখছিল।

সে কী করেছে তা উপলব্ধি না করেই কিউ তার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু যেই মাত্র সে বুঝতে পারল কিওকো পিছিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে-সঙ্গে সে তার মার্জিতভাবে তার চোখের ভ্রু দুটি তুলল এবং একটা হাত পাশে থাকা সোফার দিকে নির্দেশ করল। "আপনি কি একটু বসতে চাইবেন, মিস হোগো?" সে জানত কিওকোর মনে তার উদ্দেশ্য নানান প্রশ্ন আছে। যদি না থাকত তাহলেই বরং সে কিছুটা হতাশ হত।

কিওকো কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে ঢোক গিলল কিন্তু তারপরেই উদ্ধত ভঙ্গিতে তার চিবুক তুলল, সোফার দিকে এগিয়ে গেল, কিউয়ের থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব রেখে বসে পড়ল, আর কিছু না হোক তাতে অন্তত তার মস্তিস্ক ঠিকঠাকভাবে কাজ করতে পারবে এই আশায়। কিওকো ভিতরে-ভিতরে একটু হাসল।

"প্রথমেই যেটা আমি জানতে চাইব তা হল, আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি একজন ঋত্বিকা?" সে সতর্ক দৃষ্টিতে কিউয়ের দিকে তাকাল এবং প্রায় অদ্ভুত একটা আচরণ করল যখন সে দেখল কিউ অন্য দিকে রাখা চেয়ারটায় গিয়ে না বসে সোফায় তার পাশে বসে পড়ল। কিওকো তার শরীরটা একটু সরিয়ে তার দিকে তাকাল, যাতে তাকে আরও সরে না যেতে হয় এবং তাতে তার ভয় প্রকাশিত না হয়ে পড়ে।

'বেশ, তুমি তাহলে খেলতে চাও,' কিউ মনে-মনে এটা ভেবে বেশ আমোদিত হল, কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই মনের গোপন ভাব ঝেড়েও ফেলল। "আপনার কী থেকে মনে হল যে আপনি যে একজন ঋত্বিকা তা আমার অজানা থাকবে?" স্বভাবসিদ্ধ শান্ত ভাষায় সে পাল্টা প্রশ্ন করল। সে যখন কিওকোর পানের পাতার মতো আকৃতির মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ে তাকে জিজ্ঞাসা করছিল তখন তার তুলনায় কিওকোর চেহেরাটা খুবই ছোট লাগছিল।

কিওকো তার মুখের সমস্ত বলিরেখাগুলিকে নজর করছিল তার মধ্যে কোনরকম আবেগের ইঙ্গিত ধরা পড়ে কিনা তা দেখার জন্য এবং সেই রকমই একটা ইঙ্গিত পেয়ে কিছুটা অবাক হল। সে যেন কোন ভাস্করের নিখুঁত ও শান্ত হাতে তৈরি কোন মানুষ, আর সেটাই কিওকোকে বেশ বিব্রত করছিল।

"আপনি কি সবসময়েই প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করে থাকেন নাকি, মিস্টার…?” সে কিছুটা তোতলার মতো কথাগুলো বলে ফেলল এমনকি তার নাম পর্যন্ত না জানতে চেয়ে।

কিউ হাসল, কিন্তু মনে-মনে, তাই কিওকোর চোখে তা ধরা পড়ল না। তবে সে বলতেই পারত কিওকোর মধ্যে এখনও প্রাণবন্ততা রয়েছে এবং তাতে সে এতটুকু হতাশ হয়নি। বরং সে তার মধ্যে আরও প্রাণোচ্ছলতা দেখতে চাইছিল। "মিস্টার লর্ড, কিন্তু আপনি আমাকে কিউ বলেই ডাকতে পারেন, যদি না লর্ড নামটাই আপনার বেশি পছন্দ হয়।" এরপর ও খুব উষ্ণ দৃষ্টিতে কিওকোর মুখের উপর তাকিয়ে ওকে একেবারে কাবু করে দিল।

কিওকোর উপর তার প্রভাব ভালই পড়ল, "কেন… আমি… কি… এখানে?" সে প্রত্যেকটা শব্দ আস্তে-আস্তে এবং আলাদা-আলাদা করে বলেছিল, যেন সে কোন বাচ্চার সাথে কথা বলছে। কিউ তার এর থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসে সেটাই দেখার। ‘মিস্টার লর্ড না ছাই।’ কিওকো নিজের মধ্যেই তাচ্ছিল্যের সুর ভরে নিল, তার চোখ থেকে চোখ না সরিয়েই।

কিওকোর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে কিউয়ের সোনালি চোখ দুটি জ্বলে উঠল এবং ছোট হয়ে কিওকোর পান্না রংয়ের চোখের উপর কেন্দ্রীভূত হল। সে কিওকোর দিকে একটু ঝুঁকল, এটা বুঝতে পেরেই যে এতে কিওকো একটু ঘাবড়ে যাবে। সে ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল।

“আপনার পৌরোহিত্যের শক্তি দুর্বল এবং অপ্রশিক্ষিত, না হলে আপনি বুঝতে পারতেন আমি কীভাবে বুঝলাম আপনি একজন ঋত্বিকা,” সে কিছুটা হিসহিস শব্দে কথাগুলো কিওকোকে বলল, শুধু একবারে জন্য তার শান্তভাব হারিয়ে যার পরেই আবার তা তার চোখে-মুখে ফিরে এসেছিল। “আমি আপনাকে মার্শাল আর্ট শেখাব, আপনার শক্তি বৃদ্ধির শিক্ষা-সহ... যেটার অভাব আপনার মধ্যে রয়েছে।”

কিওকোর কাছে তার এই কথাগুলোর মধ্যে শেষেরটা কিছুটা অপমানের মতো লাগল। কিছুটা মাথা-গরম স্বভাবের বলে পরিচিত কিওকো এবার কিউয়ের দিকে ঝুঁকে প্রায় তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেল এবং তার ভঙ্গিমায় বিদ্রূপ ভরে নিল। “এমনও হতে পারে যে, আমি আমার প্রকৃত শক্তি লুকিয়ে রেখেছি, আর আমার সমকক্ষ কিছু সামনে এলেই আমি তা দেখিয়ে দেব।” তার রাগ, বা তার নির্বুদ্ধিতা, এক মুহূর্তের জন্য তাকে ভয়শূন্য করে তুলেছিল, ঠিক কোনটা সে ব্যাপারে সে ততটা নিশ্চিত ছিল না।

কিউ আরও একটু কাছে ঝুঁকল, তার ঠোঁট দুটো প্রায় কিওকোর ঠোটের কাছে নিয়ে গেল যাতে তার গরম নিঃশ্বাস কিওকো অনুভব করতে পারে। তারপর সে ঠাণ্ডা গলায় ফিসফিস করে বলল, “ঋত্বিকা।”

অধ্যায় ৪ “মনোযোগ দাও”

কিওকো ছিটকে সরে গিয়ে নিজেকে ওর থেকে দূরে নিয়ে গেল, আর হঠাৎ করেই সে কিউয়ের মধ্যে থেকে এমন আবহ পাচ্ছিল যা তার পাওয়ার কথা ছিল না। এখানে কিছু একটা হচ্ছে এবং কিওকোর মনে হচ্ছিল সে ছাড়া বাকি সবাই বোধহয় সে ব্যাপারে জানে।

“আমি এখনও আমার উত্তর পাইনি,” কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে সে ফিসফিস করে বলল, সেই সঙ্গে কিউয়ের তৈরি এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ থেকে নিজেকে মুক্ত করার আশায় নিজের নিচের ঠোঁটে নিজেই কামড় বসাচ্ছিল। সে চাইছিল এই দমবন্ধ করা রোমাঞ্চর কম্পন থেকে সে যেন দ্রুত ছাড়া পায় যা তার স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে যেন একটা বুলেট ট্রেন ছুটিয়ে বেড়াচ্ছিল।

কিওকোর শরীরের গন্ধ তার নাকে পৌঁছালে এবং তাতে তার রক্ত ফুটতে শুরু করলে কিউ নিজেকে তার থেকে সরিয়ে আনার জন্য নিজের শরীর সোজা করে নিল। সে ছোট-খাটো চেহারার মেয়েটিকে কাঁপতে দেখেছিল, কিন্তু তাতে বিদ্রোহ ছিল না। নিজের চোখ দুটিকে নিচে নামিয়ে সে মুচকি হাসল, আর তখনই সে বুঝল তার দুই বাহুর রোম খাঁড়া হয়ে গেছে।

“আপনি কেন আপনার শক্তি লুকোচ্ছেন? আপনাকে আপনার পারিপার্শ্বিক দুনিয়া সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে অতীতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবার আগেই।” কিছুটা উদ্ধত কণ্ঠেই কিউ কথাগুলো কিওকোর উদ্দেশ্যে বলল।

কিওকো ঢোক গিলে বলল, "কী বলতে চাইছেন আপনি?" ও উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল।

"আপনি তো জানেনই যে এই স্কুলে চিরঞ্জীবীরা রয়েছেন, ঠিক বলছি তো?" কিউয়ের চোখে এমন এক দ্যুতি ছিল যা কিওকো আগে কখনও দেখেনি, আর তার কণ্ঠস্বর ছিল কর্কশ যেন সে তাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। “এই যে আমরা কথা বলছি এর মধ্যেই দৈত্যেরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।”

কিওকোর চোখ দুটো একটু প্রসারিত হয়ে আবার ছোট হয়ে গেল। কিউ কি তার সঙ্গে কোন খেলা খেলছে? "আপনার কেন মনে হচ্ছে এখানে রক্ষক ও দৈত্যেরা রয়েছে?" সে কিছুটা অননুমোদনের সুরে কথাটা জিজ্ঞাসা করল।

হঠাৎ করেই কিউ এক হেঁচকা টানে কিওকোর হাতটা ধরে তাকে তুলে নিল, মুখটা ওর মুখের খুব কাছে নিয়ে চলে এল। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “মনোযোগ দাও।”

কিওকো চোখের পলক ফেলল, সে যা দেখছিল তা তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। এইভাবে কিউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে তার মনে হচ্ছিল সে সেই মানুষটা নয় যার সঙ্গে একটু আগেই সে কথা বলছিল। সেই লোকটার চোখে অস্বাভাবিক চমক, বিরক্তি, সোনালি দ্যুতি তৈরি হয়েছিল, যার নিচে সে ছোট-ছোট বিষদাঁত দেখতে পাচ্ছিল, আর তার হাতে একটা পাঞ্জা বিদ্ধ হওয়ার অনুভূতি হচ্ছিল।

লোকটার চুলের দৈর্ঘ্য কিছুক্ষণ আগেই যা ছিল তার থেকে দ্বিগুণ হয়ে গেছিল এবং তার মুখের দু’পাশে এমনভাবে ভাসছিল যেন তার অনুমতির অপেক্ষা করছে। হতচিকত হয়ে তীব্র এক চিৎকার করে কিওকো নিজেকে ওর হাত থেকে মুক্ত করল এবং দ্রুত দু’ কদম পিছিয়ে গেল, আর দেখল কিউ তাকে আরও ভীত করে তার দিকে এগিয়ে এল।

"আপনি একজন রক্ষক?" সে হোঁচটা খাওয়া কণ্ঠে জানতে চাইল।

“আর তুমি সেই ঋত্বিকা যার আগে থেকেই সে ব্যাপারে জানার কথা,” সে হিসহিস শব্দে তাকে কথাগুলো বলল যেহেতু সে বুঝতে পারছিল তার রাগ আস্তে-আস্তে চলে যাচ্ছে।

কিওকো দ্রুত ঘুরে দরজার দিকে ছুটতে যাচ্ছিল, কিন্তু সে যখন বুঝতে পারল যে, লোকটা তাকে পিছন থেকে তার দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে তখন সে চিৎকার করে উঠল।

সে যত তার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চেষ্টা করছিল কিউয়ের হাত দুটো ততই তাকে আরও শক্ত বন্ধনে বেঁধে ফেলছিল। সে তাকে জাপটে ধরে মেঝে থেকে তুলে নিয়েছিল, আর কিওকোর পা দুটো শূন্যে ছটফট করছিল তার থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টায়। ওর হাত থেকে ছাড়া পাবার চেষ্টা যে বৃথা তা উপলব্ধি করার পর্যাপ্ত সময় কিওকোকে দেবার পর, কিউ তার মুখটা কিওকোর কানের একেবারে কাছে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “শোন ঋত্বিকা, এখানে তুমি ততদিন অবধি থাকবে যতদিন না তুমি এই দুই বাহু থেকে নিজেকে মুক্ত করার মতো শক্তি অর্জন করছো।”

তারপর সে তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ওই সোফাটার উপর এমনভাবে বসিয়ে দিল যে কিওকো কিছুটা বলের মতো বাউন্স করল। এইবার তার হাত থেকে মুক্ত হয়েই কিওকো তীব্র একটা চিৎকার করল এবং তারপর চোখের পলক ফেলতেই সে আবার সেই লোকটাকেই তার সামনে দেখতে পেল যার সঙ্গে সে কিছুক্ষণ আগে কথা বলছিল।

লোকটার চোখে-চোখ রেখে, হাতের মুঠো পাকিয়ে নিয়ে, কিওকো বলল, "কী হচ্ছে এসব?"

কিউ শান্তভাবে তার সামনে দাঁড়িয়ে রইল, আর এইবার যে তফাৎটুকু ছিল ওর ভঙ্গিমায় তা হল, ওর চোখ দুটো তখনও জ্বল-জ্বল করছিল, “তুমি এখানে থাকবে।” সে কিওকোর দিকে ঝুঁকে বলল, “তুমি আমাকে তোমাকে প্রশিক্ষণ দেবার সুযোগ দেবে।” সে সোফার পিছন দিকে তার দু’হাত এমনভাবে রাখল যাতে তা কিওকোকে ঘিরে ফেলে এবং তারপর বলল, “আর এইবার, তুমি বলিদান ছাড়াই জিতবে।” কথাগুলি বলার সময় তার নাক প্রায় কিওকোর নাকের সঙ্গে ঠেকে গেছিল।

কিওকো যতটা সম্ভব সোফায় হেলান দিয়ে নিজেকে ওর থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করল, চোখ দুটোতে ততটাই হিংস্রতা রেখে, কিন্তু কোনভাবেই কিউয়ের থেকে কোন ভয়ের উদ্রেক তার মধ্যে হচ্ছিল না। সে মানুষ না হলেও কিওকোকে ক্ষতি করার কোন অভিপ্রায় ওর মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছিল না। এই মাত্র সে যেটা বলল সেটা শুনে কিওকো ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকাল।

"এই বার?" কিওকোর সুর নরম হয়েছিল, "এই বার... কী বলতে চাইছেন আপনি?"

কিউ গভীর দীর্ঘশ্বাস নিল, “তুমি হয়ত ভুলে গেছো, কিন্তু আমি যাইনি।” কিওকোর শরীরের গন্ধ তার চারিপাশে বিরাজ করছিল এবং তার বিস্মৃত হৃদয়ে সে এক ধরনের যন্ত্রণা অনুভব করছিল, কিন্তু কিওকো তো সত্যিটা জানতেই হবে, “আমরা অতীতে এক সাথে লড়াই করেছিলাম, ঋত্বিকা, আর সেই সময় এগিয়ে আসছে যখন আমাদের আবার তা করতে হবে।”

মুহূর্তের মধ্যে কিওকোর চোখের দৃষ্টি নরম হয়ে গেল, "কে আপনি?"

“তোমার রক্ষক। কিওকো, আমি জানি তুমি ভুলে গেছো, কারণ রক্ষকের অন্তর-স্ফটিককে এই বিশ্বে ফিরিয়ে আনার জন্য তুমি আমাদের ব্যাপারে তোমার স্মৃতি বিসর্জন দিয়েছো।” তার চোখের মধ্যে কিওকোর প্রতি একটা অন্বেষণ ছিল এবং সে ফিসফিস করে বলল, “তোমাকে আমার উপর বিশ্বাস রাখতেই হবে।”

কিওকোর ভিতরকার সমস্ত অনুভূতি তাকে ওই লোকটাকে বিশ্বাস করার কথা বলছিল, এমনকি একটু আগে সে তাকে চূড়ান্ত ভয় পাইয়ে দেওয়া সত্ত্বেও। “অবশ্যই... আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।” কথাটা বলা মাত্রই সে তার হাতে একটা টান অনুভব করল। প্রথমে সে তার হাতটা একটু শক্ত করে নিয়েছিল কিন্তু তার চারিপাশে যে উষ্ণতা তৈরি হয়েছিল তাতে সে নিজেকে সমর্পণ করল এবং কিছুটা দ্বিধা নিয়ে হলেও তার আলিঙ্গনে সাড়া দিল।

এবার কিউ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। অনেকটা সময় ধরে সে সব কিছুতেই প্রত্যাখ্যাত হয়ে আসছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই তার টানে কিওকোর এভাবে সাড়া দেওয়ায় সেও কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। সে তাকে বুকের মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরল এবং কিওকোর সুবাসিত মুখের উপর তার মুখটা নামিয়ে আনল।

“এবারটা থেকে যাও,” সে ফিসফিস করে কিওকোকে বলল।

কিওকোর তার কথাবার্তায় এবং তার বাহুবন্ধে একটা আবেশ অনুভব করছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও কয়েক মুহূর্তে আগেও সে এই মানুষটাকে কেমন ভয় পাচ্ছিল, আর এখন সে এমনভাবে তাকে ধরে ছিল যেন তার উপর কিওকোর সারা জীবনের জন্য ভরসা করতে পারে। কিওকো সেই মুহূর্তে তার প্রতি ভয় ও তাকে জড়িয়ে ধরে তার গালে চুম্বন করার মাঝামাঝি একটা মানসিক স্থিতিতে অবস্থান করছিল।

তার মনে প্রচুর প্রশ্ন ছিল এবং সে তার বুকে মাথা রেখে বিড়বিড় করে বলছিল, “আমি যা যা ভুলে গেছি বলে তুমি বলছ, আমি সেই সব কিছু মনে করতে চাই। আমার কী কী জানা দরকার?"

কিউ তার সোনালি চোখ বন্ধ করল কারণ বাস্তব জগতে ফেরার ইচ্ছা এই মুহূর্তে তার হচ্ছিল না... কিওকো ঠিক সেখানেই ছিল যেখানে ওর থাকার কথা... ওর বাহু-বন্ধনে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিউ তাকে নিজের বাহু-বন্ধন থেকে মুক্ত করল এবং সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজে ওর পাশে বসে পড়ল।

নিজের অতি লম্বা-লম্বা চুলের মধ্যে দিয়ে হাত চালিয়ে সে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নিজের মধ্যে তৈরি হওয়া তীব্র উত্তেজনাকে বশে আনার চেষ্টা করল। নিজেকে শান্ত করে নিয়ে সে তাদের সামনে থাকা দেওয়ালটার দিকে তাকাল এবং কিওকো যা জানতে চাইছিল তা তাকে বলতে শুরু করল। কোন কিছু মনে করা আর তা শোনা এক জিনিস নয়।

“তুমি সাহায্য পাবে। এখানে ঠিক তোমার মতো করে, স্কলারশিপ পেয়ে, যে সব ছাত্র-ছাত্রীরা এসেছে তাদের আমিই জড়ো করেছি। তোমাকে ওদের মনে নেই, তোমারও ওদেরকে না, কিন্তু সেই সময় ওরা তোমার সঙ্গে সেই লড়াইতে সামিল ছিল, এবং সময় এলেই ওরা আবারও তোমার সঙ্গে লড়বে,” তার কণ্ঠে অতীতের কোন ঘটনার স্মৃতির দরজায় কড়াঘাতের মতো শ্বাসাঘাত ছিল।

কিওকোর চোখ প্রসারিত হল, "সুকি আর শিনবে?" ওকে এতো সহজে কেন বিশ্বাস করছে সে ব্যাপারে কিছুটা বিস্মিত হয়েও সে জিজ্ঞাসা করল।

কিউ মাথা নাড়ল, “আমি দেখলাম তুমি ওদের সঙ্গে মিলিত হয়েছো। হ্যাঁ, তুমি ওদের খুবই কাছের মানুষ ছিলে, আর সঙ্গে তয়ারও যে তোমাকে সবচেয়ে বেশি আগলে রাখত।”

"তয়া?" কিওকো চোখের ভ্রু তুলে ওকে জিজ্ঞাসা করল। “তুমি নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছো।” আর সে মনে মনে বলল, ‘ও তো আমাকে পছন্দও করে না।'

কিউ অসম্মতিসূচক দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “এই জীবনে তয়ার কোন পরিবর্তন হয়নি, আর সে এখনও তার অতীত জীবনের মতোই উদ্ধত, মাথা-গরম একটা যুবকই রয়ে গেছে। কিন্তু হ্যাঁ, সে একটা প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়ে তোমাকে রক্ষা করত, এবং তেমন প্রয়োজন হলে সে তোমার জন্য নিজের জীবনও দিয়ে দিত।”

কিউকো ভ্রু কুঁচকে তাকাল, "ওর মনে নেই?" কিওকোর মনে হচ্ছিল কিউ তাকে সত্যি কথাগুলোই বলছে এবং সেগুলো যেহেতু তার ভাসা-ভাসা স্মৃতির টুকরো-টুকরো অংশগুলোর সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল তাই সেগুলো তার কাছে অর্থবহও মনে হচ্ছিল। তার চোখে কিউয়ের প্রতি প্রচুর জিজ্ঞাসা ছিল, সে তার অতীত স্মৃতি পুরোপুরি ফিরে পেতে চাইছিল।

কিউ মাথা নাড়ল, “আমি একমাত্র যে তোমার সঙ্গে ফিরে আসিনি। সেই জন্য, আমিই একমাত্র সেই ব্যক্তি যার স্মৃতিতে কী কী ঘটেছিল তার পুরোটা ধরা রয়েছে। তয়ার এমনকি এ কথাও মনে নেই যে ও আমার ভাই।”

কিওকো এই কথায় ঢোক গিলল, “ভাই? কী ঘটেছিল যে এই বিষয়গুলো শুধু তোমারই মনে আছে?" ওকে জানতেই হবে।

“আমাদের বিশ্বের অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করতে ও রক্ষকের অন্তর-স্ফটিককে রক্ষা করতে তুমি তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তোমার সব স্মৃতি খরচ করে ফেলেছিলে। আর ঠিক তখনই তুমি ওই স্ফটিকের শপথ নিয়ে সকলের সাথে আবার দেখা হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলে। তুমি তাদের হারাতে কখনোই হারাতে চাওনি। তারপর তুমি চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেছিলে, বাকি সকলেও তাই-ই গেছিল... তোমার শত্রুরাও। তুমি তোমার অজান্তেই তাদের এখানে নিয়ে এসেছো... তোমার সাথে করে।”

এই অবধি বলে সে হতাশাসূচক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “আমি আমার চারিদিকে একটা ইন্দ্রজাল বিস্তার করে রেখেছিলাম যা আমাকে ওই ধরনের ইচ্ছাশক্তি থেকে দূরে রেখেছিল,” স্মৃতির গভীরে হাঁতড়ে এই কথাগুলো বলতে বলতে সে সুদূরে তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল।

“তুমি সবাইকে তোমার সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলে কিন্তু তোমার তার কিছুই মনে নেই। তার সকলেই পুনর্জন্ম পেয়ে এখানে চলে এসেছে, তোমার এখনকার সময়ে, আমাকে একা অতীতে ছেড়ে।” এই কথা বলার সাথে সাথে তার চোখ দুটো কিওকোর চোখে এসে স্থির হয়ে গেল। “আর তাই আমি বেঁচে গেছিলাম এবং তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সময় আসা মাত্রই আমি আমাকে ছেড়ে যাওয়া সবাইকে আবার জড়ো করে নিয়েছি। তুমি এখন সেই স্ফটিককে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছো, আর সেই সব অমঙ্গলকারী শক্তিকেও যারা এর অধিকার চায়...” কিউয়ের গলার স্বর গাঢ় হয়ে গেল, “...অশুভ শক্তি ইতিমধ্যেই তোমার খোঁজ শুরু করে দিয়েছে এবং আমি তাদের তোমার কাছে পৌঁছাতে দেব না।”

কিওকো বুঝতে পারার মতো করে মাথা নাড়ল, “তাহলে, আমার মতো করে যারা যারা এখানে এসেছে তাদের কি আমি বিশ্বাস করতে পারি?” কিউ সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল এবং কিওকো বলে চলল, "তারা কি এসবের কোন কিছু জানে?"

কিউ মাথা নেড়ে না বলল, “তারা তোমার সঙ্গে একটা বন্ধন অনুভব করবে এবং সেটা বাড়তে থাকবে, কিন্তু সেটা ছাড়া ভবিষ্যতে আর কী হতে পারে তা আমি জানি না, আমি শুধু অতীতই জানি। তারা তোমাকে আগের মতোই রক্ষা করবে। তা করার জন্যই তারা জন্মলাভ করেছে... সেটাই তাদের অস্তিত্বের কারণ।”

সে দ্রুত কিওকোর জিজ্ঞাসু চোখের থেকে দূরে দৃষ্টি নিয়ে গেল এটা জেনে যে, তার কথার সত্যতা তার সঙ্গেও রয়েছে। “আমাদের হাতে এখনও কিছু সময় আছে, কিন্তু এখনকার মতো আমি চাইব তুমি তোমার ঋত্বিকা-শক্তি লুকিয়ে রাখো, এবং তোমার চারপাশ সম্পর্কে সচেতন থাকো। আমি তোমার উপর নজর রাখব, এবং আমি তয়াকেও বলে রেখেছি তোমার উপর খুব কাছ থেকে নজর রেখে চলতে।”

কিওকো তাকে খুব নিবিড় দৃষ্টিতে দেখল, তার সম্বন্ধে কিছু মনে পড়ে কিনা সেই চেষ্টায়। তার মনে হচ্ছিল সে তাকে খুব ভালভাবে চেনে, জানে। কিউয়ের চোখে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে কৌতুহলী মেয়ের মতো ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল, "আমরা কতটা ঘনিষ্ঠ ছিলাম?"

প্রশ্ন শুনে কিউ কিছুটা শক্ত হয়ে তার থেকে দূরে সরে যাবার আগে তার চারিপাশ থেকে যেন স্নেহের পরশ মাখা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। সে পিছনে হেলাম দিয়ে বসল, দরজার দিকে বড়-বড় চোখে তাকাল এবং তারপর দ্রুত চোখ ফিরিয়ে আনল কিওকোর উপর। “আমি তোমাকে যা যা বললাম সেগুলো তুমি ওদের বলো না কারণ ওরা নিজেরাই আস্তে-আস্তে সেসব মনে করতে পারবে।”

ঠিক তখনই দরজায় একটা সজোরে শব্দ হওয়াতে কিওকো এক ঝটকায় দূরে সরে গেল, এবং কোন অনুমতি ছাড়াই দরজাটা খুলে গেল।

তয়া মেয়েটির নিরাপত্তার ব্যাপারে চিন্তিত ছিল এবং সে ভিতরে এসে দেখতে চাইল কী ঘটছে, যদি কিছু না-ও ঘটে তাহলেও কিউয়ের গুরু-গম্ভীর স্বভাব থেকেও অন্তত কিওকোকে বাঁচাতে। ঘরে ঢুকেই ওর দৃষ্টি কিওকোর উপর স্থির হয়ে গেল।

“যাক, দেখে ভাল লাগছে ও এখনও কথা বলে চলেছে,” তার চোখ দুটো রূপালী রংয়ের দ্যুতি ঠিকরে পড়ছিল এই অনুভূতি থেকে যে, কিছু একটা গণ্ডগোল রয়েছে। “আপনার যদি কিওকোর সাথে কথা বলা হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে সুকি বাইরে ওর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে।” তয়া তার সোনালি চোখের দ্যুতি কিউয়ের উপর নিক্ষেপ করল এটা না জেনেই যে, কিউয়ের চারিপাশে একটা রূপালী আলোর বলয় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল।

কিউ তয়ার দিকে তার স্বভাবসিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল, এবং নিঃশব্দে মাথা নেড়ে ওদের যেতে বলল।

কিওকো তয়ার দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকাল, কারণ এখন তার মধ্যেকার নতুন চেতনা তাকে বলছিল তয়া তার ব্যাপারে চিন্তিত ছিল, যদিও সে তার আচরণে তা বুঝতে না দিলেও।

'তোমার জন্য সে তার জীবনও দিয়ে দিত।' কিউয়ের কথাগুলো ওর মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।

কিউ তয়ার সাথে কিওকোকে সহজ হয়ে যেতে দেখছিল, এবং দূরত্ব রেখে হলেও তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার আঁচ পেয়ে সে একটু চোখ পাকাল। তার এই ধরনের অনুভূতির ব্যাপারে সে ওয়াকিবহাল ছিল, এবং রূপালী চোখের রক্ষকের উপর তার চোখ দুটো কেন্দ্রিভূত হয়ে গেল। কিওকো কি সবসময়েই তার ভাইয়ের সঙ্গে এমনই একটা বন্ধন রেখে চলবে যা সে অন্য কারো সাথেই রাখে না?

কিওকো উঠে দাঁড়াল, কিউয়ের উদ্দেশ্যে একটা অন্তরঙ্গ হাসি হেসে তাকে বিদায় জানাল যেটা তয়ার চোখে পড়ল না, তারপর তয়ার দিকে ঘুরে তার স্বভাবসিদ্ধ মিষ্টি হাসি নিয়ে তয়ার দিকে এগিয়ে গেল। “চলো, সুকিকে আর অপেক্ষা করিয়ে রাখা ঠিক হবে না।” এই বলে সে তয়ার পাশ দিয়ে হেঁটে দরজার বাইরে চলে গেল, আর তয়া তার এই উষ্ণ আচরণে স্থির হয়ে সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এক এমন অনুভূতি যা সে কিওকোর মিষ্টি হাসির মধ্যে দিয়ে পেয়েছিল।

সে নিজের মাথা ঝাঁকিয়ে কিওকোর থেকে আসা সেই উষ্ণতাকে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করল এবং তারপর কিউয়ের দিকে কটমট করে তাকাল এবং দেখল সে তখনও ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। “কী হল?” তয়া কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল এটা জেনেও যে সে তার কোন উত্তর পাবে না। সে আর বেশি জল ঘোলা করতে চাইল না এবং দরজাটাকে দড়াম করে বন্ধ করে দিয়ে বাইরে চলে গেল এবং দ্রুত পায়ে হেঁটে কিওকোর পাশে এসে উপস্থিত হল।

তয়া পিছন থেকে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাওয়া কিওকোকে দেখছিল। সে নিশ্চয়ই কিউয়ের থেকে যত দ্রুত সম্ভব দূরে চলে যেতে চাইছিল। তয়া নিজের মধ্যেই মুচকি হাসল, তাকে ধরার জন্য দ্রুত পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল, নিজেকে রক্ষকের ভূমিকায় বিবেচনা করে। তার ভাবনা কিছুটা গভীর হল এই ভেবে যে, কিওকো কি আদৌ জানে তয়া আসলে কে। এ ব্যাপারে তার সন্দেহ ছিল, না হলে সে তার দিকে তাকিয়ে ওভাবে হাসত না।

সিঁড়ির একেবারে উপরে কিওকো বুঝতে পারছিল তয়া তাকে ধরে ফেলেছে কারণ সে তার পিছনে তয়ার উপস্থিতি অনুভব করতে পারছিল। হ্যাঁ, কিওকো তার শক্তিশালী উপস্থিতি বেশ বুঝতে পারছিল, কিন্তু সেই অনুভূতি কিছু হলেও কিউয়ের থেকে আলাদাই ছিল। সে এক মুহূর্তের জন্য তার দু’চোখ বন্ধ করে নিল। এই ভাবে চোখ বন্ধ করে সে তার দেহসৌরভ নিতে চেষ্টা করল তা সে যতই খারাপ ব্যবহার তার সঙ্গে করে থাকুক না কেন, কিন্তু তার দেহসৌরভ তাকে উষ্ণতা দিচ্ছিল এবং সে... আরও অনেক কিছুর মধ্যে... খুবই সুরক্ষিত বোধ করছিল।

সে বুঝতে পারছিল তয়ার বয়স কিউয়ের থেকে কম হওয়ার কথা, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার মধ্যে যে নিহিত শক্তি ছিল তা সে স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিল। এমন এক শক্তি যা, যদি তাকে ধরা যায়, তয়াকে এক নিমেষে তার দাদাকেও ছাপিয়ে যেতে পারে... যদিও তাদের দু’জনের মধ্যে কেউ সে ব্যাপারে সতেচন কিনা তা নিয়ে তার সন্দেহ হচ্ছিল। কিওকো তার এই ধরনের চেতনার ব্যবহার খুব উপভোগ করছিল, বিশেষকরে যখন সে আবার তা নিজের মধ্যে ফিরে পেয়েছিল।

"তাহলে…" সে তয়ার দিকে ফিরল, "…সুকি আর শিনবে কই?"

তয়া তার চোখ ছোট করে ওর দিকে তাকাল কারণ তার মিথ্যে ধরা পড়ে গেছিল। সুকি আর শিনবে কোথায় সে কীভাবে জানবে? সে তো শুধু কিওকোকে কিউয়ের থেকে সরিয়ে নিয়ে আসার জন্যই ঘরের মধ্যে গেছিল।

“আমি জানি না,” সে অলস কণ্ঠে ভেঙ্গে-ভেঙ্গে কথাগুলো বলল।

কিওকো ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল, “কিন্তু তুমি তো বলেছিলে...”

তয়া তাকে কথা শেষ করতে দিল না। “তোমাকে বাঁচানো জন্য তোমার আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ,” কিওকোর দিকে ঝুঁকে পড়ে তাকে কিছুটা ভয় পাইয়ে দেবার মতো ভঙ্গিতে সে তাকে বলল।

"আমাকে কীসের থেকে বাঁচানোর কথা বলছো?” তার এই উত্তর সে পছন্দ করেনি এটা বুঝিয়ে দিয়ে কিওকো গজগজ করে তার মুখের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞাসা করল। এমন এক বিরক্তমাখা বিস্ময় যার প্রত্যাশা সে হয়ত করছিল।

“কিউয়ের থেকে,” তয়া হাতের মুখো পাকিয়ে কিওকোর কথার পিঠেই গজগজ করে কথাগুলো বলল। কিওকো তার মিষ্টি মুখটা বেঁকিয়ে তার কথায় নিজের অসম্মতি জানাল। ‘মিষ্টি মুখ?’ কোথা থেকে যে এল সেটা? তয়া কিছুটা বিভ্রান্তের মতো কিওকোর দিকে তাকিয়ে তার থেকে এক পা পিছিয়ে গেল।

তারপর অবাক হল এটা দেখে যে, কিওকো প্রায় এক মিনিট ধরে ফ্যাল-ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর হঠাৎই সে প্রথমে আস্তে-আস্তে, আর তারপর উচ্চস্বরে হো-হো করে হেসে উঠল। "তুমি বাঁচিয়েছো?” হাসতে-হাসতেই সে কিছুটা দম নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করল। “তুমি বাঁচাতে যাবে কেন...” সে তারা হাসির গতি থামিয়ে আস্তে-আস্তে জিজ্ঞাসা করল, এবং সবশেষে তার হাসিতে একটু দুষ্টুমির ভাব নিয়ে এসে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

“ব্যাপারটা খুবই আনন্দের। আমি জানতাম না তুমি এতটা খেয়াল রাখতে পার,” সে তার দিকে তাকিয়ে মুখ একেবারে সোজা রাখার চেষ্টা করে নিজের নাক কুঁচকালো।

তয়াও তার প্রত্যুত্তরে গোল-গোল চোখ করে কিওকোর দিকে তাকাল। "তাহলে এত কিছুর পরও কি তুমি এখানে থেকে যেতে চাইবে, ‘ঋত্বিকা’?” শেষ শব্দটা সে এমনভাবে উচ্চারণ করল যেন শব্দটা তার মুখে একটা বিস্বাদ ভরে দিয়েছিল।

কিওকোর হাসি মিলিয়ে গেল এবং সে তার মাথাটা উপরের দিকে তুলে কটকট করে তয়ার সোনালি চোখের উপর নিক্ষেপ করল। "হ্যাঁ, আমি চাইব, ‘রক্ষক’," এক দিকের চোখের ভ্রু নাচিয়ে সে কথাগুলো বলল, আর তারপর পিছন ঘুরে হাসতে-হাসতে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল।

‘হ্যাঁ!’ কিওকো নিজের মনে বলল এবং তার দিকের বোর্ডের উপর মনে-মনেই একটা টিক চিহ্ন বসিয়ে দিল। ‘কিওকো এক… তয়া শূন্য।’

দুষ্টু-মিষ্টি মেয়েটা যে তার মনে প্রবেশ করে গেছে সেটা বোঝার আগেই তার চোখ দুটো প্রসারিত আনন্দে প্রসারিত হল। “ধুৎ!” বলে সেও তার পিছনে-পিছনে ছুটতে লাগল।

কিওকো প্রায় সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে খেয়াল করল তার ঋত্ত্বিক চেতনা যেন কোন কিছুর দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। তয়ার পাশে আরও এক রক্ষকের উপস্থিতি অনুভব করে কিওকো চারিপাশটা দেখার জন্য তাকাল। এই ধরনের অনুভূতি তৈরি করতে পারে এমন সবচেয়ে কাছে থাকা যাকে সে দেখল সে একজন ছাত্র যে সিঁড়ির ঠিক নিচেই দাঁড়িয়েছিল, আর কিওকোকে উৎসাহ ভরা চোখে দেখছিল।

কাছ থেকে তাকে দেখে কিওকো তার অবিন্যস্ত চুলের হালকা বেগুনি হাইলাইট এবং তার অত্যন্ত সুন্দর দুটো চোখ দেখতে পেল। চোখ দুটোর দিকে ভাল করে তাকিয়ে কিওকো হলফ করে বলতে পারত... সে তার দুই চোখের তারায় বর্ণালীর সবকটা রংয়ের ঝলকানি দেখতে পেয়েছিল।

এই সময় তয়া কিওকোর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। ওকে হঠাৎ করে থেমে যেতে দেখে তয়া লক্ষ্য করল সে আসলে কামুইকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ‘বেশ, ও তাহলে এখন চিরঞ্জীবীদের শনাক্ত করতে পারছে,’ তয়া মনে-মনে ভাবল। তয়া একটু নিচে ঝুঁকে কিওকোর হাতটা ধরে নিল, “চলো আমি ওর সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিই।”

কামুইয়ের সাথে প্রথমবার দেখা হওয়ার সাথে-সাথেই তয়ার ওর জন্য একটা আলাদা স্নেহ তৈরি হয়েছিল। কামুই সম্পর্কে তয়া যতটুকু জানত তা হল, ওর বাবা-মা নেই এবং সে কোন শিশু পালক সংস্থার তত্ত্বাবধানে বড় হচ্ছিল যতদিন না কিউ তাকে এখানে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছিল।

কিওকো নিজেকে তয়ার হাতে ছেড়ে দিয়েছিল যাতে তয়া তাকে টেনে আগন্তুকের কাছে নিয়ে যেতে পারে। সে যে একজন চিরঞ্জীবী তা কিওকো বুঝতে পারছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার মধ্যে এক অস্বাভাবিক উদারতা সে লক্ষ্য করতে পারছিল। সে তার উপস্থিতিকে নিবিড়ভাবে নিরীক্ষণ করছিল এবং তার মধ্যে একটা উষ্ণতা অনুভব করতে পারছিল... এমন এক নিহিত অপাপবিদ্ধতা যা শুধু একটি শিশুর মধ্যেই থাকে।

"আরে তয়া, তুমি কাকে এখানে নিয়ে এসেছো?" কামুইয়ের চকচকে চোখ দুটো অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে কিওকোকে দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল সে যেন বহু কাল কিওকোর অপেক্ষাতেই ছিল... এমন কি কিওকো আসলে কে সে ব্যাপারে তার কোন ধারণা না থাকা সত্ত্বেও। ভাবটা কিছুটা এমন যে সে ভীষণভাবে ওর অভাব বোধ করছিল। মনে হচ্ছিল সে যেন নতুন করে নিঃশ্বাস নিতে পারছিল এবং সে সেই মুহূর্তে একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে তা প্রমাণের চেষ্টা করল, কিন্তু নিঃশ্বাস নেওয়া বায়ু তার শ্বাসনালী দিয়ে যাবার সময় সে যেন তাতে কিওকোর গন্ধ পেল যার সঙ্গে সে খুবই পরিচিত ছিল।

তয়ার দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কী করলে... যাও নিজের জন্য একটা গার্লফ্রেন্ড খুঁজে নাও গে?” মুচকি হেসে কথাগুলো বলার সময় কামুইয়ের চোখ দুটোতে অন্যরকম চমক ছিল।

“যাচ্ছেতাই,” তয়া বলে উঠল। “ও একেবারেই আমার পছন্দ মতো নয়।”

“তুমি সেটা বুঝবে কীভাবে? তোমার তো কোনদিন কোন গার্লফ্রেন্ডই ছিল না।” নিজের বলা কথা শেষ করে কামুই নিজেই হো-হো করে হেসে উঠল।

কিওকো না হাসার অনেক চেষ্টা করল কিন্তু কামুইয়ের হাসি আর ওর চোখের ভঙ্গির সাথে তয়ার মুখের ভাব দেখে সে আর তার হাসি চেপে রাখতে পারল না।

“ও কিওকো,” তয়া কিওকোর দিকে হাত প্রসারিত করে তাকে দেখালো যেন সেটা কিওকোকে স্পর্শ করার কথা মনে করতে পারছিল। “কিওকো, ওর নাম কামুই। কামুইও এখানে তোমার মতোই স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে এসেছে, আর তোমরা দু’জনে একই ক্লাসে পড়বে।”

“হ্যাঁ, আমি এখানে মুফতে খাওয়াদের মধ্যে একজন, ” মুখ উঁচু করে এমন ভঙ্গিতে কামুই কথাগুলো বলল যে কিওকো হাসি চেপে রাখতে পারলা কারণ সে সেই দলে সে-ও যে পড়ছিল।

সে কামুইয়ের দিকে ঘুরল এবং নিজের হাত বাড়িয়ে দিল। তার মুখে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি ছিল আর নিজের ভিতরে সেই তথ্যটা চাপা দেওয়ার প্রয়াস যে, কামুই যদি এখানে স্কলারশিপ পেয়ে এসে থাকে, তাহলে সে-ও এমন কেউ যাকে কিওকো অতীতে চিনত, “হাই কামুই, তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল লাগল। অ্যাকাডেমিতে তুমি কতদিন ধরে রয়েছো?"

কামুইয়ের ইতিমধ্যেই এই মিশুকে মেয়েটাকে পছন্দ হয়ে গেছিল। “বছর দুয়েক মতো। রগচটা ছেলেটা তোমার সঙ্গে কী করছে? তোমাকে সব ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে বুঝি?" এই বলে সে তয়ার দিকে তাকাল, তারপর আবার কিওকোর দিকে, এবং হাসি মৃদু করে আনল। কামুই এইবার কিওকোর একটা হাত তার হাতের মধ্যে নিল। শরীরটা কিছুটা ঝুঁকিয়ে হাতটাকে নিজের ঠোঁটের কাছে টেনে এনে তালুর উল্টো দিকে একটা চুম্বন করল।

এই দেখে তয়া যেভাবে কটমট করে তার দিকে তাকাচ্ছিল তাতে কামুই হো-হো করে হেসে উঠল। কিওকোর প্রতি তয়ার আকর্ষণ এতটাই স্পষ্ট ছিল যা শুধু একজন নির্বোধেরই চোখ এড়াতে পারত।

কিওকো একটু লজ্জা পেল এবং ‘রগচটা’ শব্দটা মনে করে মুখ চেপে হাসল। তয়া যেভাবে কামুইয়ের দিকে কটমট তাকাচ্ছিল তা দেখে কিওকো বেশ মজা পাচ্ছিল। “আমরা আসলে শিনবে আর সুকির খোঁজ করছিলাম। তুমি কি ওদের দেখেছো কোথায়...”

কিওকো তার কথা শেষ করার আগেই কেউ তার হাতটা ধরে তাকে এক টানে কামুই আর তয়ার মাঝখান থেকে সরিয়ে নিল। কিওকো হতচকিত হয়ে তার দিকে তাকাতেই তার চোখ দুটো সুকির চিন্তিত চোখের উপর গিয়ে পড়ল।

"সব ঠিক আছে তো কিওকো? তুমি শেষ অবধি থাকছো তো তাহলে?" সুকির জিজ্ঞাসায় যেন অনুনয়ের ছাপ ছিল।

সুকির কথা শুনে কিওকোর কিউয়ের মৃদু গলায় তাকে থেকে যাবার অনুরোধের কথা মনে পড়ে গেল এবং সে সুকির উদ্দেশ্যে সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল। “আমি যাচ্ছি না।” এই কথা বলতে-বলতে সে সুকির কাঁধের পিছন দিয়ে শিনবেকেও দেখতে পেল এবং তার এই উত্তরে শিনবের চোখেও একইরকম সন্তুষ্টির ছাপ লক্ষ্য করল।

На страницу:
4 из 5