bannerbanner
সময়ের অন্তর
সময়ের অন্তর

Полная версия

সময়ের অন্তর

Настройки чтения
Размер шрифта
Высота строк
Поля
На страницу:
1 из 5


দ্য হার্ট অব টাইম

দ্য গার্ডিয়ান হার্ট ক্রিস্টাল সিরিজ বই ১

অ্যামি ব্ল্যাঙ্কেনশিপ

অনুবাদক: চন্দ্রিল মণ্ডল

গ্রন্থস্বত্ব © 2008 Amy Blankenship

ইংরেজি সংস্করণের প্রকাশক অ্যামি ব্ল্যাঙ্কেনশিপ

দ্বিতীয় সংস্করণের প্রকাশক TekTime

সব স্বত্ব সংরক্ষিত।

সময়ের অন্তরের কিংবদন্তি

দুনিয়া বদলে যায়... কিন্তু প্রকৃত অর্থে কিংবদন্তিরা কখনও হারিয়ে যায় না।

সময়ের একেবারে শুরু থেকেই আলো আর অন্ধকার নিরন্তর একে-অপরের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছে। এক-একটা বিশ্বের ভাঙ্গা-গড়া চলছে তাদের স্রষ্টার পদতলে, কিন্তু তা সত্ত্বেও শুভ আর অশুভর নিরন্তর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনদিন কোন প্রশ্ন হয়নি। যদিও, কোন কোন সময় এই মিশ্রণের মধ্যেই কোন নতুন জিনিস নিক্ষেপিত হয়... সেই জিনিস, যা চায় দুই পক্ষই কিন্তু পায় কোন এক পক্ষই।

চারিত্রিকভাবে বিরোধাভাসপূর্ণ এই রক্ষকের অন্তর-স্ফটিক হল সেই ধ্রুবক যা এই দুই পক্ষই বরবার অর্জনের প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। আমাদের পরিচিত বিশ্বকে সৃষ্টি ও ধ্বংস করে দেবার ক্ষমতা এই স্ফটিকাকৃতির পাথরটির রয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি আবার একই সাথে দুনিয়ার সমস্ত দুঃখ-কষ্টেরও অবসান ঘটাতে পারে। কিছু লোকের মতে এই স্ফটিকের নিজস্ব মন আছে... আবার অন্যদের মতে এই সব কিছুর পিছনে রয়েছেন ঈশ্বর।

প্রতিবার যখন স্ফটিকটি আবির্ভুত হয়েছে, এর রক্ষকেরা সর্বদা একে সেই সব লোকেদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তৈরি থেকেছেন যারা এটিকে স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করবে। এই সব রক্ষকদের পরিচয় কোনদিন বদলায়নি এবং তারা সমকালীন জগৎ বা সময় নির্বিশেষে একইরকম প্রাবল্যের সঙ্গে এটিকে ভালবেসে এসেছেন।

বহু প্রাচীন এই রক্ষকদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক মেয়ে, যে এদের বড়ই স্নেহের। মেয়েটির নিজের মধ্যেই এই স্ফটিকের নিজস্ব শক্তি নিহিত আছে। সেটাই স্ফটিকের ধারক ও শক্তির উৎস। এই দুইয়ের মধ্যেকার রেখাটি অনেক সময় ঝাপসা হয়ে যায়, এবং স্ফটিকটিকে রক্ষা করার কাজটি ক্রমপর্যায়ে অন্য রক্ষকদের হাত থেকে এই ঋত্বিকাকে রক্ষা করায় বদলে যায়।

এই সেই সুরা যা অন্ধকারের অন্তরের পানীয়। এটি স্ফটিকের রক্ষকদের দুর্বল করে দেবার ও আক্রমণের অবস্থায় নিয়ে আসার সুযোগ। অন্ধকার এই শক্তির কামনা করে এবং সেই সঙ্গে সেই মেয়েরও কামনা করে ঠিক যেমনভাবে কোন পুরুষ কোন নারীর করে থাকে।

এই মাত্রা ও বাস্তবতাগুলির প্রতিটির মধ্যেই তুমি একটি গোপন উদ্যানের সন্ধান পেতে পারো যা সময়ের অন্তর (Heart of Time) নামে পরিচিত। সেখানে হাঁটু মুড়ে বসা এক কমবয়সী ঋত্বিকার প্রতিমা দেখতে পাওয়া যাবে। তাকে ঘিরে রয়েছে শতাব্দী-প্রাচীন এক যাদুবিদ্যা যা তার গোপন সম্পদকে লুকিয়ে এবং অত্যন্ত যত্নে সংরক্ষিত রাখে। কুমারী প্রতিমার দুই বাহু প্রসারিত, যেন অত্যন্ত মূল্যবান কোন কিছু তার হাতে এসে ধরা দেবার অপেক্ষায় সে রয়েছে।

কিংবদন্তি আছে, সে আসলে সেই শক্তিশালী পাথরটি তার হাতে ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছে যার নাম রক্ষকের অন্তর-স্ফটিক (Guradian Heart Crystal)।

এই প্রতিমার আসল রহস্য ও কীভাবে এর সৃষ্টি হয়েছিল তা শুধু রক্ষকেরাই জানেন। পাঁচ ভাইয়ের জন্মের আগেই তাদের পূর্বপুরুষ, তাদামিচি ও তার যমজ ভাই হায়াকুহেই, এই সময়ের অন্তরকে তার অন্ধকারতম ইতিহাসকালে রক্ষার কাজ করছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই যমজ ভাই সেই বিভেদপ্রাচীরকে রক্ষা করে এসেছে যা মানবজাতিকে দৈত্যদের দুনিয়ায় পদার্পণ করা থেকে আটকায়। কাজটি ছিল খুব পবিত্র এবং মানবজাতি ও দৈত্যদেরকে একে-অপরের থেকে বাঁচিয়ে ও আড়াল করে রাখার জন্য তার দরকার ছিল।

তাদের রাজত্বকালে, অপ্রত্যাশিতভাবে, এই পবিত্র স্ফটিকের কারণে কতিপয় মানব দুর্ঘটনাবশত ওই বিভেদপ্রাচীর গলে দৈত্যদের রাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হয়। কোন এক বিশৃঙ্খলার সময় এই স্ফটিকের শক্তি ওই বিভেদপ্রাচীরে চিড় ধরায় যা এই দুই জগৎকে আলাদা করে রাখত। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মানবজাতির নেতা ও তাদামিচি নিজেদের মধ্যে মৈত্রী স্থাপন করে এবং বিভেদপ্রাচীরের ওই ফাঁক বুজিয়ে দিয়ে আবার এই দুই জগৎকে একে-অপরের থেকে চিরতরে আলাদা করে রাখার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।

কিন্তু ওই সময়েই হায়াকুহেই ও তাদামিটি উভয়েই ওই মানবজাতির নেতার মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়।

হায়াকুহেইয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাদামিচি ও মেয়েটির বাবা মিলে ওই ফাটল বুজিয়ে দেয়। বিপজ্জনক ত্রিকোণ প্রেমকে চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ওই বিভেদপ্রাচীরের জোর আরও দশগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে হায়াকুহেইর হৃদয় খান-খান হয়ে যায়... তার নিজের ভাই, তাদামিচি, কিনা তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে ও তার প্রিয় ঋত্বিকাকে চিরতরে আলাদা করে রাখার বন্দোবস্ত নিশ্চিত করে দিল!

ভালবাসা শুধু ভালবাসার মানুষ তৈরি করে না, হারানো ভালবাসা ভয়ংকর অপরাধী তৈরি করতে পারে। হায়াকুহেইয়ের ভগ্ন-হৃদয় তার মধ্যে আক্রোশের আগুন জ্বালিয়ে নিল এবং হিংসায় অন্ধ হয়ে সে তার নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হল, যা তাদামিচির জীবন শেষ করে দিয়ে দুই যমজ ভাইয়ের অমর আত্মাকে আলাদা করে দিল। অমরত্বের সেই ছোট ছোট টুকরো পাঁচজন নতুন রক্ষক সৃষ্টি করল যারা ওই বিভেদপ্রাচীরের রক্ষা করবে এবং তাকে হায়াকুহেইয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখবে যে অশুভ জগতে প্রবেশ করে দৈত্যদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল।

অন্ধকার জগতের আঁধারে আটক হায়াকুহেই সময়ের অন্তরকে রক্ষা করার তার সমস্ত সংকল্প বিস্মৃত হয়েছিল... উল্টে সে তার সমস্ত শক্তি ওই প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার উদ্দেশ্যে কাজে লাগিয়েছিল। তার ঘন কালো লম্বা চুল, যা হাঁটুর নিচ অবধি যায়, এবং তার চূড়ান্ত সম্মোহনকারী মুখ তার দেবদূতের মতো চেহারা-ছবির পিছনে প্রকৃত অশুভ চরিত্রকে লুকিয়ে রেখেছিল।

আলো ও অন্ধকারের শক্তির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে, কুমারী ঋত্বিকার পুনর্জন্ম লাভের ও অন্য প্রান্তে স্ফটিক ভেসে ওঠার সংকেতস্বরূপ ওই পবিত্র প্রতিমা থেকে চোখধাঁধাঁনো নীল রংয়ের আলো নির্গত হল।

রক্ষকেরা যেহেতু তার কাছাকাছি চলে আসে এবং তার রক্ষী হয়ে ওঠে, তাই শুভ ও অশুভর যুদ্ধ সত্যি-সত্যিই শুরু হয়ে যায়। তাই অন্ধকার জগতের প্রবেশপথ আলোর জগতের মধ্যেই রয়ে গেল।

তাদের বহু মহান দুঃসাহসির কাজের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম...

অধ্যায় ১ "খণ্ডবিখণ্ড স্মৃতিমালা”

"কিওকো!!!!!!"

তয়ার চিল-চিৎকার জঙ্গলের সব প্রান্ত থেকে শোনা যাচ্ছিল। সেই চিৎকারের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল এবং সব কিছু আবার নিথর, শান্ত হয়ে উঠল, আর সবাই হায়াকুহেই এরপর কী করে তা দেখার অপেক্ষায় চেয়ে রইল।

কেউ-ই এটা থামাতে পারত না। সব কিছু এত দ্রুত গতিতে ঘটে গেছিল যে কেউ কোন প্রতিক্রিয়া দেবার সময়ই পেয়ে ওঠেনি। যা ঘটেছিল তাতে ওই পাঁচ রক্ষকের সকলেই স্থবির হয়ে পড়েছিল। তারা বিশ্বাসই করতে পারেনি যে, তারা রক্ষকের অন্তর-স্ফটিককে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে হায়াকুহেইয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে... আর শুধু তাকে পরাজিত করতে, একত্রিত হয়েছিল। শুধু সেই মানুষটাকেই হারাতে যাকে তারা সকলেই ভালবাসত এবং রক্ষা করত।

ওদিকে, যুদ্ধক্ষেত্রের একেবারে কেন্দ্রস্থলে যেন তাদের সবচেয়ে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।

হায়াকুহেই কিওকোকে জাপটে ধরে রেখেছিল আর তার ভয়ার্ত মুখের উপর তার দৃষ্টি স্থির করে রেখেছিল। আর হায়াকুহেইয়ের পূর্বপরিকল্পনা মতোই কিওকোর শরীরের নিচের অংশ তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। হায়াকুহেই ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করতে চেষ্টা করছিল এবং রক্ষকের অন্তর-স্ফটিককে তার দেহে এবং তার শূন্যতাকে তার অন্তঃকরণে মিশিয়ে নিতে চেষ্টা করছিল। এই দৃশ্য যারা দেখছিল তারা স্ফটিকের মধ্যে বিকৃতি আসতে দেখতে পাচ্ছিল, সেই অন্ধকার তার মধ্যে দেখতে পাচ্ছিল যা শুধুমাত্র অশুভ শক্তি থেকেই আসে।

কিওকো পাগলের মতো হায়াকুহেইয়ের থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টায় তার বুকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছিল, তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সে সেই রক্ষক প্রভুর থেকে মুক্তির চেষ্টা করছিল যে সদ্য দৈত্যে পরিণত হয়েছে; আর হায়াকুহেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল।

হায়াকুহেই সেই মুহূর্তে শারীরিক শক্তির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছিল যা তার মাংসপেশি আর রক্তবাহের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল আর কিওকোর মুক্তি পাবার সেই বৃথা প্রচেষ্টা তার হাসির খোরাক জোগাচ্ছিল। তার লম্বা, ঘন, কালো চুল তাদের দু’জনকেই এমনভাবে আঁকড়ে ধরছিল যেন সেই নিজেই একটা জলজ্যান্ত প্রাণী। সেই মধ্যরাতের মতো মিশমিশে কালো চুলের প্রান্তভাগগুলো এমনভাবে কিওকোর পিছনে একে-অপরের সাথে একটা লোহার ফিতের মতো করে নিজেদের বুনে নিচ্ছিল যাতে কিওকো তার ছোট্ট শরীরটাকে হায়াকুহেইয়ের শরীরে পড়ে যাওয়া থেকে আটকাতে পারে।

কিওকো তার শরীরের সেই টানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ক্রমশ অসহায় হয়ে পড়ছিল যা তাকে হায়াকুহেইয়ের শরীরে মিশিয়ে দিচ্ছিল। কিওকো সেই অন্ধকার, শীতল শূন্যের মধ্যে পড়ে যেতে চাইছিল না যা আসলে হায়াকুহেইয়ের অন্তরাত্মা। সে সেই শূন্যের মধ্যে তার জন্য অপেক্ষারত সমস্ত দৈত্যদের উপস্থিতি অনুভব করতে পারছিল। কিওকোর শরীরের যে যে অংশ সেই শূন্যের মধ্যে প্রবেশ করছিল সেই সেই অংশ শীতল হয়ে উঠছিল। তার পা দুটো ঠাণ্ডা হয়ে বরফের মতো হয়ে গেছিল এবং তার পায়ের সমস্ত ত্বক জুড়ে কেউ যেন লক্ষ-লক্ষ পিন ফুঁটিয়ে দিচ্ছিল।

কিওকো বুঝতে পারছিল যে, সে যদি দ্রুত কিছু একটা না করতে পারে তাহলে সে তার দুটো পা-ই হারাবে। কিওকো সেই পাঁচ ভাইকে দেখতে পাচ্ছিল যারা গত কয়েক বছর ধরে তার রক্ষা করে আসছিল... তারা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তাকে দেখছিল। তারা প্রত্যেকেই তাকে বাঁচাতে চাইছিল কিন্তু যতক্ষণ অবধি তাকে একটা বর্মের মতো করে সামনের দিকে ধরে রাখা হয়েছে ততক্ষণ অবধি তারা তার কাছে যেতে ভয় পাচ্ছিল।

কিওকো রক্ষকদের বিশ্বাসঘাতকের হাতে পরাজিত হতে চাইছিল না। এ তো ওদের সকলের কাকা… সে কেন এত কাল আগে তাদের ভাইপো-ভাইঝিদের বিরুদ্ধে চলে গেছিল? কিওকোর পান্নার মতো সবুজ দু’চোখ ভয়ংকর ক্রোধ নিয়ে ঘুরে তার শত্রুর মুখে এসে স্থির হয়ে গেছিল। তার এই অবস্থা হবার কথা ছিল না... অন্তত সে যেমনটি থেকে এসেছে তাতে তো নয়ই। পুরোটাই হয়েছিল তার নিজের ভুলের জন্যই।

তার চোখের দৃষ্টি হায়াকুহেইয়ের তীক্ষ্ণ চাউনির উপর সন্নিবিষ্ট হল। কিওকোই এই স্ফটিক এই জগতে নিয়ে এসেছিল এবং এটা তাকেই এই জগত থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে যদি তাকে সেটা নিয়ে নরকেই যেতে হয়।

কুড়ি ফুটেরও কম দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা কিউ উন্মত্ত গতিতে তার ধ্বংসাত্মক তলোয়ার ‘হাকাইশা’-কে টেনে বের করে আনল। সে কিছুতেই তার কাকার... তার শত্রুর, এই ভাবনাকে মেনে নিতে পারছিল যে সেই মানব-কন্যাকে স্পর্শ করেছে যাকে কখনও পরম শ্রদ্ধা করত। ওই উন্মাদের দুই বাহু-পাশে কিওকোকে এতটাই ভঙ্গুর একটা বস্তুর মতো দেখাচ্ছিল যে, লড়াইটা এখন অশুভর বিরুদ্ধে পবিত্রর লড়াইয়ে পর্যবসিত হয়েছিল।

রক্ষকদের রাজ্যের প্রভু... কিউ, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বয়োঃজেষ্ঠ, সেই মুহূর্তে যা করতে পারত তাতে কিওকোর আঘাত লাগা ছাড়া আর কিছুই হত না। সে মনে মনে জানত যে, স্ফটিকের শক্তি তার কোন ক্ষতি করতে পারত না কারণ এই লড়াই শুরু হবার আগেই সে এমন এক জাদুমন্ত্র ব্যবহার করেছিল যা অন্য সমস্ত জাদুবিদ্যাকে আটকে দেয়। বস্তুত, সে হায়াকুহেইয়ের দ্বারা রক্ষকের অন্তর-স্ফটিক তার বিরুদ্ধে ব্যবহারে জন্য একপ্রকার তৈরিই ছিল।

কিন্তু এখন যেটা ঘটছে... সে কখনও তার কল্পনাই করেনি। সে কোনভাবেই কিওকোকে আহত করতে চায়নি... কখনোই না, অন্তত ততক্ষণ অবধি তো নয়ই যতক্ষণ তার হাতে তাকে আটকাবার ক্ষমতা আছে।

কোন অত্যন্ত অন্ধকারময় দুঃস্বপ্ন থেকে উঠে আসা হায়াকুহেইয়ের ছেড়ে দেওয়া সেই দৈত্য-পিশাচেরা যখন মাটি থেকে ঘষটে-ঘষটে উঠে তার শরীরকে আঁকড়ে ধরে তাকে স্থবির করার চেষ্টা করছিল তখন সে এতটুকুও অসুবিধায় পড়েনি। কিউ তার ছোট ভাই তয়ার চোখে ভয়ংকর আগুন দেখতে পেল।

হায়াকুহেইয়ের তার কিছু দৈত্য-পিশাচ দিয়ে তয়াকে আক্রমণ করেছিল, তাকে স্থবির করে দেবার চেষ্টায়, কিন্তু তয়া তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধের চেষ্টা তখনও ছটফট করছিল। ভিতরে-ভিতরে, কিউ তার ভাইয়ের উপর থাকা এই প্রতিরোধী শক্তিকে ধন্যবাদ দিচ্ছিল... কারণ যদি তা না থাকত, তাহলে তয়া ভবিষ্যৎ পরিণামের কথা না ভেবেই আক্রমণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিওকোকে এইরকম এক বিপদে পড়তে দেখে তয়া দিক-বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছিল।

কিউ তয়ার প্রতিটা হৃদস্পন্দের সাথে সাথে তার রক্ষকের শক্তির তীব্রতার বৃদ্ধি অনুভব করতে পারছিল, যার মধ্যে তার নিজের ও তার ভাইয়েদের শক্তিও মিশে ছিল।

দশ ফুটেরও কম দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা কোতারোর বরফের মতো নীল চোখ অবিশ্বাসের বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠেছিল। সে কোনভাবেই কিওকোকে আহাত হতে দেখতে চাইছিল না, কিন্তু তা যাতে না হয় তার জন্য তার কিছু করারও ছিল না। তার দুই বাহুই যুদ্ধের রক্তে সিক্ত ছিল এবং তার পা দুটোও খুব একটা ভাল অবস্থায় ছিল না। তার নিজের ব্যথায় এই মুহূর্তে সে এতটাই কাতর ছিল যে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেও তার কষ্ট হচ্ছিল, আক্রমণ করার মত শক্তি তো তার ছিল না। সে সবচেয়ে বেশি যে মেয়েটিকে ভালবাসত তার জন্য তার মন ভয়ে পাথর হয়ে গেছিল।

"ওর যেন এতটুকু আঘাত না লাগে, হায়াকুহেই, তাহলে আমি তোকে নরক থেকে টেনে বের করে আনব," কোতারে তার ধরা গলায়, তার বিষদাঁত বের করে, তার বরফের মতো নীল চোখে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে নিয়ে কথাগুলো বলেছিল। তার চারপাশের বায়ুও যেন প্রতিশোধের আগুনের উষ্ণতা পেয়ে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল, তার শক্তি-প্রবাহের ফলে তার চারিপাশের ধ্বংসাবশেষ একটা বৃত্ত তৈরি করে উড়ছিল।

কামুই ভয় পেয়ে গেছিল এবং কিওকোকে হায়াকুহেইয়ের বাহু-পাশে ছটফট করতে দেখে তার মস্তিস্কে তালা গেলে গেছিল। তার চোখে বহুবর্ণের ধূলিকণা ক্রোধের আগুনে চিকচিক করছিল। কোন পরিণামের কথা না ভেবেই, কামুই তার দুই পাঞ্জা প্রসারিত করে হায়াকুহেইয়ের দিকে ছুটে গেছিল, ঋত্বিকার জন্য তার ভালবাসা থেকে উদ্ভুত সেই অকল্পনীয় শক্তিকে সবাই প্রত্যক্ষ করেছিল।

হায়াকুহেইয়ের ছায়া দৈত্যেরা, তার শরীরকে নিরেট ধ্বংসাবশেষের মধ্যে আছড়ে, নোংরা উড়িয়ে, তাকে পিছু হঠতে বাধ্য করেছিল।

কেয়েন, যে লড়াই চলাকালীন পুরো সময় ধরে সর্বকনিষ্ঠ রক্ষককে চোখে-চোখে রাখছিল, শক্ত হাতে কামুইকে তাদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল এবং তার দু’পায়ের চলনে আগুন উড়ছিল। নিস্তেজ কামুইকে বাঁচিয়ে নিয়ে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে কেয়েন আগুন-ঝড়ানো চোখে হায়াকুহেইয়ের দিকে তাকাল এবং সর্বকনিষ্ঠ রক্ষক ও তার বিপদের মাঝখানে এসে দাঁড়াল।

সুকি তখনও তার বাবাকে দু’হাতে ধরে হাঁটুগেড়ে মাটিতে বসে ছিল। তার শরীর এখন নিথর এবং সেনিমকে হত্যার জন্য হায়াকুহেইয়ের প্রতি তার ঘৃণা সুকির অন্তঃকরণে টগবগ করে ফুটছিল। সুকির চোখ এইবার কিওকোর উপর এসে স্থির হয়ে গেছিল। সে তার সবচেয়ে ভাল বান্ধবীকে সেই নিয়তির হাত থেকে রক্ষা করতে চাইছিল যা তার বাবার মতো বুদ্ধমান বৃদ্ধকে শেষ করে দিয়েছিল।

শিনবে সুকির ঠিক সামনেই তার রক্ষাকবচের মতো দাঁড়িয়েছিল, হায়াকুহেইয়ের দৃষ্টি থেকে তাকে আড়াল করে। কোতারোর রোষানল থেকে উদ্ভুত বায়ু শিনবের মুখের উপর এসে পড়া তার মিশমিশে কালো চুল হাওয়া উড়াচ্ছিল... যা তার নীলকান্ত মণির মতো চোখে ভয়ার্ত এক অভিব্যক্তি তৈরি করেছিল। স্ফটিক ভবনের শক্তির অনুভূতি হওয়ামাত্র কিওকোর জন্য তার চিন্তা আরও তীব্র হয়ে উঠল।

সহসা তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে যাওয়া কোন বায়ু যেন তার মুখ থেকে “না….” শব্দ বের করে এনেছিল। শিনবে এ কথা জানত যে, হায়াকুহেই যদি রক্ষকের অন্তর-স্ফটিকের সমস্ত শক্তি হস্তগত করে ফেলে, তাহলে দুই জগতের সামনেই সমূহ বিপদ উপস্থিত হয়ে পড়বে। আর এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সে কিছুই করতে পারছিল না এই কথা ভেবে তার দু’চোখ বেয়ে অগ্নিরূপ অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকল। “…কিওকো।”

হায়াকুহেই তার চারিপাশে এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা তার শত্রুদের দিকে তাকাল... তার নিজের ভাইয়ের পুত্রের দিকে তাকাল। ও জানত এরা সবাই ওকে আক্রমণ করতে ভয় পাচ্ছে কারণ এই মুহূর্তে কিওকো তার কজ্জায় রয়েছে তার ঢাল হিসেবে এবং সে তার চারিপাশে ক্ষোভের আগুনের লেলিহান শিখা অনুভব করতে পারছিল।

তার মিশকালো দুই পাখা প্রসারিত হল, যা তার পিছনে একটা অন্ধকার পটভূমি রচনা করল, আর সেই সঙ্গে তার ততধিক কালো দুই চোখ তার হাতে থাকা মেয়েটির উপর স্থির হয়ে রইল। "ওরা তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।" সে খুব শান্ত স্নিগ্ধ গলায় বলল। তার কথা এমন ছিল যেন তারা কেউ-ই এই যুদ্ধভূমিতে নেই, বরং তারা বাইরে থেকে তা দেখছে।

সে সেই পবিত্র রক্ষকের অন্তর-স্ফটিকের স্পর্শ অনুভব করতে পারছিল যেটা তখনও তার উন্মুক্ত ছাতির ঠিক মাঝখানে জ্বলজ্বল করছিল। কিওকোকে রক্ষার জন্য লড়াই করা রক্ষকদের প্রতি কিওকোর ভালবাসাই সেই একমাত্র জিনিস ছিল যা ওই স্ফটিকের অবশিষ্ট অংশটা হায়াকুহেইয়ের শরীরে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাচ্ছিল না, তাকে সেই শক্তির সুখ দিয়ে যা তার চির-আকাঙ্খার বিষয়।

কিওকোর সেই বিশুদ্ধ ভালবাসাই তার শক্তি, আর তাই দিয়েই সে হায়াকুহেইয়ের শরীর থেকে পবিত্র স্ফটিকটিকে টেনে বের করে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছিল... হায়াকুহেই তা বেশ অনুভব করতে পারছিল। কিন্তু তার সাথে সাথে সে সেই শক্তিকেও অনুভব করছিল যা সেই মুহূর্তে তারা শিরা-ধমনীর মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল, এবং যা তাকে আরও আরও পেতে প্ররোচিত করছিল।

হায়াকুহেইয়ের চোখ দুটো কয়েক মুহূর্তের জন্য নরম হয়ে গেল যখন কিওকোর সাথে ফিসফিস করে কথা বলছিল যেমন করে কোন প্রেমিক তার প্রেমিকার সঙ্গে বলে। “এটা যথেষ্ট নয়।”

হায়াকুকেই ঠিক করল যে সে এখনও অবধি ওই পবিত্র স্ফটিক থেকে যতটুকু শক্তি অর্জন করতে পেরেছে তাকেই কিওকোর বিরুদ্ধে কাজে লাগাবে এবং তার এই ভালবাসর বন্ধনকে ভেঙ্গে ফেলতে চেষ্টা করবে যা তার শরীরের চারিপাশ বেষ্টন করে রয়েছে। সে বুঝতে পেরেছিল যে, তাকে যে কোনভাবে হোক কিওকোকে নিরস্ত করতেই হবে... কারণ কিওকোর ভালবাসার শক্তি নিজের মধ্যেই সেই পবিত্র স্ফটিকের শক্তির সমকক্ষ যা এক সময় তার হাতেই ছিল। এ সেই স্ফটিক যাকে এক সময় ভালবাসার অধিকার তার ছিল... যতক্ষণ অবধি না সেই অধিকার নিষ্ঠুরভাবে তার হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

সে এক ঝটকায় কিওকোর মুখটা নিজের মুখের কাছে টেনে নিল এবং আলতো করে তার নিষ্পাপ ঠোঁটের উপর একটা চুম্বন করল। তার চঞ্চল সুবজ চোখে তাকিয়ে হায়াকুহেই রক্ষকের অন্তর-স্ফটিকের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তার অন্তঃকরণে প্রবেশ করল।

হায়াকুহেই রক্ষকদের প্রতি তার স্নেহস্মৃতির খোঁজ করল যাদের কিওকো অত্যন্ত ভালবাসত... হায়াকুহেই ওর থেকে তা নিয়ে নেবে। সে যাদের জন্য লড়াই করত সেই সব মানুষগুলোর স্মৃতি কিওকোর থেকে চুরি করে নিলে কিওকোর শক্তি কমবে এবং সেই শক্তি হায়াকুহেইকে আরও শক্তি জোগাবে।

কিওকো তার চোখের পাতা ফেলতে পারছিল না। কিওকো তার মনের মধ্যে হায়াকুহেইয়ের অশুভ পাঞ্জার চলাফেলা অনুভব করতে পারছিল যা তার স্মৃতিকে নষ্ট করে দিতে চাইছিল এবং এই লড়াইয়ে তার সংকল্পকে খানখান করে দিতে চাইছিল... তার ভালবাসাকে তার থেকে আলাদা করে দিতে চাইছিল। তার বন্ধুরা, তাদের সকলেই, সে নিজেও এটা হতে দিতে পারে না।

কিওকো বুঝতে পারছিল সে তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, তার কাছে শুধুমাত্র একটাই জিনিস থেকে যাচ্ছে হায়াকুহেইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য, আর সেটা হল সেই জিনিস যা হায়াকুহেই তার থেকে ছিনিয়ে নিতে এবং তাকে ধ্বংস করে দিতে চাইছিল। তার চোখে ক্রোধের আগুন আর চাপা দেওয়া যাচ্ছিল না। কিওকো হায়াকুহেইয়ের রেশমি, মিশকালো চুলের মধ্যে তার হাতি চালিয়ে দিয়ে তাকে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরল এবং তার কপালে নিজের কপাল সজোরে আঘাত করল, যা শক্তি এক তরঙ্গ তৈরি করল।

কিওকোর প্রবল চিৎকারে গোটা যুদ্ধক্ষেত্র ফেটে পড়ল। "এতটাই খারাপ হোক চেয়েছিলে তো? নাও তবে!! এই নাও!!!!"

কিওকোর সোনালি চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল যা থেকে যেন একটা উত্তপ্ত ছুরির মতো ত্রাস ছিটকে বেরিয়ে হায়াকুহেইকে বিদ্ধ করছিল। ঋত্বিকা কী করছিলেন? হায়াকুহেই জানত কিছু একটা মারাত্মক ভুল হয়ে যাচ্ছে এবং তার ভিতর থেকে তার মানসিক শক্তি তাকে ডাকছিল... যেন তাকে শোনার জন্য এবং অনেক দেরি হয়ে যাবার আগে একবার দেকে নিতে আকুতি জানাচ্ছিল। সে সেই শক্তিকে গুটিয়ে এনে কিওকোর মনের ভিতরে প্রবেশ করেছিল, কী ঘটছে তা দেখার জন্য। তার ছায়া দৈত্যরা তাকে চারপাশ থেকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে না থাকলে... একেবারে স্থিরভাবে, সে যা দেখতে পেয়েছিল তাতে হায়াকুহেই নিজের হাঁটুতে ভর দিয়ে মাটিতে পড়ে যেত।

সেই ছবি ও আওয়াজগুলি চিরতরে তার মনের চোখে বসে যাবে এবং কিওকো কোনভাবে জানত যে, হায়াকুহেই সেই অনুভূতিগুলিকে নাড়াতে পারবেই না যেগুলি তার উপর দিয়ে বয়ে গেছিল। কারণ তার অন্তঃকরণের চোখে চোখ রেখে হায়াকুহেই বুঝতে পেরেছিল যে, কিওকোর অন্তরে তার জন্য ও তার ভাইদের জন্যও ভালবাসা রয়েছে। সেই প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি আবেগঘন আদর দেখতে পাচ্ছিল এবং সেই প্রতিটি লুকানো ভালবাসার অশ্রু দেখতে পাচ্ছিল যা অবশ্যই কিওকোর মধ্যে তার জন্যই ছিল।

কিউ একেবারে ভিতর থেকে নড়ে উঠেছিল এই সময় কারণ সে জানতে কিওকোর মধ্যে যে কোন কারো থেকেই অনেক বেশি শক্তি রয়েছে... এমনকি তার মধ্যে এমনও শক্তি আছে যা কিওকোর নিজেরই অজানা। কিউ সেই প্রতিটি স্মৃতিকে দেখতে ও অনুভব করতে পারছিল যেগুলো কিওকোর মন থেকে বেরিয়ে হায়াকুহেইয়ের মনে প্রবেশ করছিল, যেন কোন তীর তার মনের মধ্যে ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ছিল যেখান থেকে সে আর সেগুলোকে কখনই বের করবে না।

বহু বছরের ভালবাসা, মর্মপীড়া এবং ত্যাগ... এক মুহূর্তেই সব চলে যাচ্ছে।

ক্রোধের আগুনে গলে যাওয়া অশ্রু কিওকোর গাল বেয়ে নামছিল আর সে প্রত্যেকের জন্য তার ভালবাস ও বন্ধুত্বের, যন্ত্রণার ও রহস্যের অনুভূতির স্মৃতিগুলোকে হায়াকুহেইয়ের মনের মধ্যে থেকে টেনে বের করে নিজের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল। তার হাতে এই শেষ অস্ত্র ছিল।

একেবারে সাথে সাথেই হায়াকুহেইয়ের অশুভ শক্তি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ল। স্ফটিকটি অন্ধ আলো থেকে উজ্জ্বল সাদা আলোয় দপদপ করতে দেখে সকলেই শক্তির হাতবদল বুঝতে পারছিল, আর তখনই তয়া ও কিউকে আঁকড়ে ধরে থাকা অপচ্ছায়াগুলির মুষ্টি শিথিল হয়ে বায়ুর সঙ্গে মিলিয়ে যেতে থাকল।

কিওকো এখন অন্ধকারের দেবদূতকে বিভ্রান্ত অবস্থায় দেখতে পেল, তার ফ্যাকাসে মুখটা যন্ত্রণায় দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিল।

ঠিক যে মুহূর্তে কিওকো বুঝতে পারল যে সে পিছলে বেরিয়ে আসছে তখনই সে ছোট-ছোট দুই বাহু প্রসারিত করল এবং স্ফটিকটিকে শক্ত করে ধরল এবং হায়াকুহেইয়ের মাংসপিণ্ডের মধ্যে থেকে টেনে বের করে নিল। কিওকো জানত কী করা উচিত, কারণ সে বেশ অনুভব করতে পারছিল যে সে তার মনে সেইসব স্মৃতিগুলোকে দ্রুত হারাচ্ছে যেগুলোকে সে হারাতে চাইত না। ইতিমধ্যে অশ্রুধারা বয়ে যাওয়ার চিহ্ন থাকা তার গাল বেয়ে স্ফটিকাকৃতির চোখের জল নামছিল।

সে তার সমস্ত স্মৃতিগুলোকে হারিয়েছিল তাদের সকলে বাঁচাতে। দ্রুতগতিতে, তার চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলার আগেই, সে রক্ষকের অন্তর-স্ফটিককে তার বুকের সঙ্গে চেপে ধরেছিল... তার হৃদয়ের মুখোমুখি।

তারপর মুখ ফিরিয়ে তয়া আর কিউয়ের দিকে তাকিয়ে, যারা তার দিকেই এগিয়ে আসছিল, সে ফিসফিস করে বলল, “আমাকে মনে রেখো... আমার খোঁজ কোর।”

তার দৃষ্টি এক কালো অন্ধকার সুড়ঙ্গে প্রবেশ করার আগে শেষ যে দৃশ্য কিওকো দেখতে পেয়েছিল তা হল তয়া ও কিউ চিৎকার করে তার নাম ডাকছিল এবং তার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল। ওদের দু’জনের একজনের চোখ ছিল সোনালি আর অপরজনের চোখ ছিল গলিত রূপার রংয়ের... আর তারপরও কিওকোর জগৎ অন্ধকারে ডুবে গেল।

কিওকোর মিলিয়ে যাওয়া এবং সে যে মারা যেতে চলছে সেই ভাবনা কিউ অনুভব করতে পারছিল। সে তয়ার সঙ্গে সমলয়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিওকোর কাছে পৌঁছানোর মরিয়ে চেষ্টা করছিল, আর ঠিক তখনও সব বদলে গেল, যেন এক বিন্দু জল তার চোখের মণিতে এসে আছড় পড়ল। কিওকোর দিক থেকে তরঙ্গ তৈরি হল, আর সে মধ্যগগনে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর তারই সঙ্গে মিলিয়ে যেতে যেতে ক্রোধে উম্মত্ত হায়াকুহেইয়ের চিৎকারও শোনা গেল।

কিউয়ের মনটা ছাৎ করে উঠল যখন তার সঙ্গে একই স্বরে চিৎকার করতে থাকা তার ভাইয়ের কণ্ঠস্বর হঠাৎ করে থেমে গেল, কেউ যেন এক নিমেষে কণ্ঠের তার ছিন্ন করে দিয়েছিল, এবং সে বুঝতে পারল তয়াও তাদের সাথেই মিলিয়ে গেল। কিউ ঝপ করে সেই খালি বদ্ধভূমিতে এসে পড়ল যেখানে মাত্র এক মুহূর্তে আগেই তার অভীষ্ট লক্ষ্য অবস্থান করছিল। তার ক্রুদ্ধ চোখের দৃষ্টি চারিদিকে তাকে খুঁজল কিন্তু কাউকেই আর দেখতে পেল না। সকলেই অদৃশ্য হয়ে গেছিল।

কিউ তার অ্যাড্রিনালিক গ্রন্থিতে প্রচন্ত আলোড়ন অনুভব করতে পারছিল এবং বুঝতে পারছিল তা থেকে ক্ষরিত রস তার রক্ষক রক্তে গিয়ে মিশছে। কোন কিছুই তার দৃষ্টি আর অনুভূতির বাইরে ছিল না। সে এখন কিওকোর সবটুকু স্মৃতির মালিক হয়ে রইল। কিওকো তাদেরকে বাঁচাতেই তার জীবনের সবটা দিয়ে গেছিল, আর তার চলে যাবার আকের মুহূর্ত অবধি কিউ তার সেই অঙ্গীকার শুনতে পেয়েছিল। কিওকো হয়ত জানতেই পারেনি সে কী করে গেছিল... কিন্তু সে তার সবকিছু তার সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেছিল, শুধু কিউকে পিছনে ফেলে রেখে।

কিউ তার চারিদিকে যে সম্মোহন বিছিয়ে রেখেছিল যাতে ওই পবিত্র স্ফটিককে তার বিরুদ্ধেই কাজে লাগানো না যেতে পারে, সেই সম্মোহনী শক্তিই তাকে অন্যদের গন্তব্য অনুসরণে অক্ষম করে তুলেছিল। মাত্র কয়েকটা ফিসফিস শব্দেই কিওকো তার থেকে তার সব কিছু ছিনিয়ে নিয়েছিল।

তার শরীর ঋজু ও উদ্ধত অবস্থায় ছিল। তার হাঁটু অবধি বিস্তৃত রূপালী রংয়ের চুল তার দেহের চারিদিকে ঝুলছিল এবং তার সাদা রংয়ের রেশমের জামার হাতা হাওয়ায় পৎপৎ করে উড়ছিল যেন সে কোন অদৃশ্য ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল যে ঝড়ের সঙ্গে তার ক্রোধে অন্ধ হয়ে যাওয়া তার অন্তরের মধ্যে চলা ঝড়ের মিল ছিল।

তার দৃশ্যপট থেকে মিলিয়ে যাওয়া মল্লভূমির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা তার চেহারা-ছবি অনেকটা কোন দেবদূতের মতো লাগছিল... রাজকীয়, পরাক্রমী এবং নিষ্কলঙ্ক। সহসা সে তার হাত তার গালে নিয়ে এল যেখানে একাকী এক অগ্নিবর্ণ অশ্রু ধীরে ধীরে নেমে আসছিল যাকে আটকানোর মত ক্ষমতা তার সেই সময় ছিল না।

কিউয়ের দৃষ্টি পাখির গা থেকে খসে পড়া পালক যেভাবে ভেসে বেড়ায় সেইভাবেই ভেসে বেড়াচ্ছিল, তাকে এক বিশালাকার সোনালি দমকে মুড়ে দিয়ে, তার বয়স-বিহীন জীবনকে প্রথমবারের জন্য উদ্ঘাটিত করে।

এই মল্লভূমি থেকে যে একমাত্র আঘাত সে পেয়েছিল তা তার হৃদয়ে আড়াআড়িভাবে প্রতীত হচ্ছিল... সেই হৃদয় যা আদৌ আছে বলে কেউ কোনদিন ভাবেনি। তার দৃষ্টি আন্দোলিত হচ্ছিল সেই কুমারী প্রতিমার উপর যা মাত্র কয়েক ফুট দূরত্বেই দাঁড়িয়েছিল এবং সে ফিসফিস করে বলে উঠল, “কিওকো, আমি তোমাকে ত্যাগ করিনি। তোমাকে আবার খুঁজে পেতে এক হাজার বছরের দূরত্বও আমার কাছে কিছুই নয়….”

অধ্যায় ২ "অপর দিক"

সময়ের অন্তরের অপর দিকে, দু’বছর পরে... এবং ভবিষ্যতে এক হাজারেরও বেশি বছর পরে।

চিঠিটা হোগো মঠের উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছিল। কিছু আগেই পত্রবাহেকর দেওয়া অতি সুন্দর দেখতে ওই খামটাকে হোগোদাদু তার সঙ্গে করে নিয়ে তার সেই টেবিলের দিকে ফিরে যেতে যেতে সেটাকে দেখলেন, যেখানে বসে তিনি চা পান করছিলেন। দরজায় কড়া নাড়া শোনার আগে অবধি তিনি তার বেশিরভাগ সময়ে অতি সক্রিয় থাকা বাড়ির শান্তি ও নীরবতা উপভোগ করছিলেন।

বাকি সকলেই সেই সন্ধ্যের জন্য বাইরে বেরিয়েছিল। তামা তার বন্ধুদের সঙ্গে শহরের গেম ক্লাবে, আর কিওকো লাইব্রেরিতে পড়তে গেছিল, অন্যদিকে, মিসেস হোগো কিছু মুদিখানা সামগ্রী কেনাকাটার জন্য বেরিয়েছিলেন।

টেবিল থেকে একটা ছুরি তুলে নিয়ে দাদু সোনালি তারের প্রান্তের খামটির একপ্রান্তে চালিয়ে দিলেন। তারপর ভিতরে হাত চালিয়ে সোনালি তারের পান্তযুক্ত উচ্চমূল্য প্রদত্ত চিঠিটা বের করে আনলেন এবং পড়তে শুরু করে দিলেন। তিনি যত পড়ছিলেন তার চোখ ততই বিস্ফারিত হচ্ছিল। বিষয়টা ছিল একটা স্কলারশিপ প্রসঙ্গে, শহরের অপর প্রান্তের শহরতলির কোন এক অতি ব্যয়বহুল স্কুলের সম্পূর্ণ পঠন-পাঠনের স্কলারশিপ।

"কে.এল. বিশ্ববিদ্যালয়।" বহু বছর পর প্রথমবার তার বৃদ্ধ কণ্ঠে বিস্ময়ের শ্বাসাঘাত দেখা গেল। তাতে লেখা ছিল, সমস্ত খরচ মিটিয়ে দেওয়া হবে, এমনকি সে যে ছাত্রাবাসে থাকবে তার ভাড়াও, এবং তাতে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতার স্বাক্ষর ও তার নামের অদ্যাক্ষর কে.এল. লেখা ছিল।

দাদুর বৃদ্ধ মুখটাতে বহু বছর পর চওড়া হাসির রেখা দেখা গেল। কিওকো আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়তে চলেছে। তিনি জানতেন ও এ ব্যাপারে খুবই চিন্তিত ছিল যে, স্কুলে এতদিন ধরে না যেতে পারার কারণ হয়ত ওকে আর কোন স্কুলেই নেওয়া হবে না এবং ওর পড়াশোনা হয়ত শেষই হয়ে যাবে, কিন্তু এখন ও সব্বাইকে টপকে সেই স্কুলে যেতে চলেছে যেটা এই অঞ্চলের অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের থেকে ভাল।

কিছু একটা চিন্তায় তার কপালে ভাঁজ পড়ল... এটা এমন একটা স্কুলে যেটাতে ভর্তি হতে পারাটা সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার, কারণ তার চেনা কাউকেই তিনি আজ অবধি এই স্কুলে ভর্তির জন্য আবেদন করে সফল হতে দেখেননি। আবার এই রটনাও আছে যে, এই স্কুলে নাকি শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম যেহেতু এখানে ভর্তি হতে গেলে অত্যন্ত উচ্চমানের আবশ্যকতা পূরণ করতে হয়। ও কীভাবে এমন একটা স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেল যার জন্য ও আবেদন পর্যন্ত করেনি?

তার মাথায় গত দু’বছরের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা ঘোরাফেরা করতে লাগল। মঠ থেকে সব কিছু ভুলে গিয়ে কিওকো যখন ফিরে এসেছিল তখন তার স্বাভাবিক হতে বেশি কিছুটা সময় লেগে গেছিল। সে হঠাৎ করে কবে ফিরে এসেছিল সে ব্যাপারে এরা সকলেই বেশ বিভ্রান্ত ছিল, কারণ ও চলে যাবার পর থেকে ওর আর বিশেষ কিছু মনে ছিল না।

На страницу:
1 из 5